
৮০ এর দশকে এক প্যাকেট আরাবিক রুটির “খবুজ” মূল্য ছিল স্থানীয় মুদ্রায় ৫০ পয়সা, বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সেই একই মূল্য ধরে রেখেছে কুয়েত সরকার। মোটামুটি বলাচলে প্রায় অর্ধ শত বছর ধরে কুয়েতের রুটির মূল্য অপরিবর্তিত।এই তথ্যটি জ্যেষ্ঠ প্রবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া, যদিও এরও অনেক আগ থেকেই রুটির মূল্য ৫০ পয়সা ছিল বলে অনেকে বলেছেন।
১৭ হাজার ৮২০ বর্গকিলোমিটারের আয়তন পশ্চিম এশিয়ার দেশ কুয়েত। আরবের উত্তরাঞ্চলীয় পারস্য উপসাগরের প্রান্তে এর অবস্থান।
ছোট দেশ, প্রায় পনেরো লাখ জনসংখ্যার এই দেশটিতে স্থানীয় নাগরিকদের তুলনায় তিন গুণ বেশি প্রবাসীরা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত।
এর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ দক্ষ-অদক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশীরা কুয়েতে কর্মরত রয়েছেন।
বিশ্বে সবচেয়ে দামি মুদ্রায় প্রথম, মধ্যপ্রাচ্যে ধনী দেশ হিসেবে তৃতীয় ও বিশ্বে ধনী হিসেবে ৩১ তম স্থান পাওয়া দেশের নাম কুয়েত।
২০২৩ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় কুয়েতের অবস্থান নবম। ওই পরিসংখ্যানে প্রতিদিন গড়ে ২,৭০০,০০০ সাতাশ লক্ষ ব্যারেল তেল উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে।
কুয়েত বিশ্বের অন্যতম একটি তেল সরবরাহকারী দেশ।তেল কুয়েতের জিডিপির প্রায় অর্ধেক, রপ্তানির প্রায় ৯৫ শতাংশ এবং সরকারের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী তেলের প্রায় ৭ শতাংশ মজুদ রয়েছে কুয়েতেই। বর্তমানে এদেশটিতে প্রতিদিন প্রায় ৩.১৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে।
বিভিন্ন খাতে আমদানি নির্ভরশীল একটি দেশ কুয়েত।দেশটির চাহিদার সিংহভাগ পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে। শিল্প- কলকারখানা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
কুয়েতের যে কয়টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন
প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম কুয়েত ফ্লাওয়ার মিলস অ্যান্ড বেকারি কোম্পানি।
এটি একটি ফ্যাক্টরি, সেখানে বিস্কুট, ময়দা, রুটি, বান এবং উদ্ভিজ্জ তেলের মতো পণ্য উৎপাদন করা হয়।
১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানিটি তাদের বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে বহু সুনাম কুড়িয়েছে।
শুধুমাত্র গেলো ২০২২ সালে প্রায় ৫২ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার (প্রায় ১৭০ মিলিয়ন ডলার) মোট মুনাফা অর্জন করেছে কুয়েত ফ্লাওয়ার মিলস্।
এই কোম্পানিতে প্রবাসী বাংলাদেশিসহ প্রায় ৪ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন।
কুয়েত ফ্লাওয়ার মিলস অ্যান্ড বেকারিতে তৈরিকৃত বিভিন্ন পণ্য স্থানীয় নাগরিদের রেশন হিসেবে প্রদান করা হয়ে থাকে। ওই কোম্পানি বা বেকারিতে বিস্কুট, কেক,ম্যাকারনি,পাস্তাসহ বিভিন্ন পণ্য বানানোর পাশাপাশি রুটিও বানানো হয়।
যে রুটির মূল্য স্বল্প, কিন্তু এর গুরুত্ব অপরিসীম। স্থানীয় নাগরিকদের কাছে আরাবিক রুটি হিসেবে পরিচিত “খবুজ” অত্যন্ত সম্মানের।রুটির অপচয় তারা মোটেও সহ্য করেননা।
কুয়েত সরকার প্রত্যেকটি মুদি দোকানে আরাবিক রুটি বিক্রি বাধ্যতামূলক করেছেন।যদিও বিক্রেতাদের জন্য এটি একটি অলাভজনক পণ্য, তবুও এক প্যাকেটে ৫টি রুটি ৫০ পয়সা মূল্য ধরে কিনে একই ধরে বিক্রি করতে হয়।
বাংলাদেশি অধ্যুষিত আব্বাসিয়া এলাকায় বিগ বাজার সুপার মার্কেটের মালিক বাহার মিয়া বলেন, তার দোকানে সহস্রাধিক প্রকার পণ্য রয়েছে, কমবেশি সব পণ্য বিক্রি করে লাভবান শুধুমাত্র রুটি “কবুজ” ব্যতীত।
তিনি বলেন, এতে তার কোনো অভিযোগ নেই, এটিও এক ধরনের সেবামূলক কাজ।
বাহার বলেন, রুটি দোকানে রাখতেই হবে।মাঝেমধ্যে স্থানীয় প্রশাসন পণ্যের গুণগত মান ও মেয়াদ দেখতে আসে।তখন রুটি “খবুজ” দোকানে আছে কিনা সেটিও তারা জিজ্ঞেস করে থাকে।
এশিয়ান সুপারশপের সত্ত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর খান পলাশ অন্য আরেকজন ব্যবসায়ি বলেন, রুটি দোকানে রাখা মানে, এই পণ্য নিতে আসা ক্রেতারা অন্য আরেকটি পণ্য কিনবে।তাছাড়া এটি পরিক্ষিত যে,যেসব মুদি দোকানে রুটি নেই, সেসব দোকানের কাস্টমার সংখ্যা কম।
জাহাঙ্গীর বলেন, রুটি “খবুজ” কুয়েতের সর্বত্রে পাওয়া যায়। কম মূল্যের এই পণ্যের প্রতি কাস্টমারের আগ্রহ বেশি।
কুয়েত প্রবাসী সিলেটের মিহির কান্তি পাল বলেন, ৯০ এর দশকে কুয়েত-ইরাক যুদ্ধের সময় ৫০ পয়সার আরাবিক রুটি আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।ওই সময় কুয়েতে খাদ্য সংকট দেখা দিলে আমরা রুটি খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলাম।
কুয়েত প্রবাসী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রশিদ মিয়া বলেন, করোনাকালীন লকডাউনের কারণে রুটি সরবরাহ ঠিকমতো হচ্ছিলনা;তখন আমি ফ্রোজেন করে অনেক প্যাকেট রুটি রেখেছিলাম, ফলে আমাকে খুবেকটা খাবারের সমস্যা পোহাতে হয়নি।
কুয়েত সরকার জনসাধারণের স্বার্থে বেশ কিছু খাতে প্রচুর পরিমাণের ভর্তুকি দিচ্ছে।
তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, কৃষি,গ্যাস,বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং খাদ্যসামগ্রীসহ ইত্যাদি।
স্থানীয় ইংরেজি দৈনিক আরব টাইমস এক রিপোর্টে উল্লেখ করে যে, গত ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে শুধুমাত্র খাদ্য ও নির্মাণ সামগ্রী খাতে ভর্তুকি হিসেবে কুয়েত ব্যয় করেছে ২২৪.২ মিলিয়ন (কুয়েতি দিনার)।
এতে সহজেই অনুমেয় যে, খাদ্যের অংশ হিসেবে আরাবিক রুটিতে “খবুজে” কী পরিমাণের ভর্তুকি দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি।
জ্বালানি তেলের চেয়ে পানির মূল্য বেশি কুয়েতে কেউ ধোঁয়ায় উড়িয়ে দেন ৫০ পয়সা আবার কেউ কেউ সকালের ব্রেকফাস্ট, দুপুরের লাঞ্চ কিংবা রাতের ডিনারও সেরে নেন এই ৫০ পয়সার আরাবিক রুটি বা খবুজ দিয়ে।
মিশরীয় নাগরিকদের আরাবিক রুটি হচ্ছে প্রথম পছন্দ,রুটির সঙ্গে ফ্রেশ টমেটো,শসা আর পেয়াজ হলেই ব্যাস চলে। তবে প্রবাসী বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিকদের রুচি একটু ভিন্ন, আরাবিক রুটি খাবারের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে তাদের ডিম ভাজি,সবজি ভাজি কিংবা তরকারি চাই চাই’ই।
মোটকথা, মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েতে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে আরাবিক রুটি বা খবুজ।
এ দেশটির খবুজ আমির-গরীব সবার প্রিয় খাবার হিসেবে পরিচিত।

সম্পাদকীয়- আ হ জুবেদ